ইতিকাফ এর গুরুত্ব |
ইতিকাফ কি? ও কেন
ইতিকাফ আরবি শব্দ । এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে কোনাে স্থানে আটকে পড়া বা থেমে যাওয়া । শরিয়তের পরিভাষায় , আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি
নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুনিয়ার সংশ্রব , বন্ধন , সম্বন্ধ ও পরিবার - পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে ( মহিলাদের জন্য ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে ) অবস্থান করে ইবাদত করাকে ইতিকাফ বলে । ইতিকাফ যেকোনাে সময় করা যায় । রমজান মাসের শেষ ১০ দিন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া । যিনি ইতিকাফ করেন , তাকে মু ' তাকিফ বলে ।
নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত দুনিয়ার সংশ্রব , বন্ধন , সম্বন্ধ ও পরিবার - পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদে ( মহিলাদের জন্য ঘরের একটি নির্দিষ্ট স্থানে ) অবস্থান করে ইবাদত করাকে ইতিকাফ বলে । ইতিকাফ যেকোনাে সময় করা যায় । রমজান মাসের শেষ ১০ দিন সুন্নাতে মুয়াক্কাদা আলাল কেফায়া । যিনি ইতিকাফ করেন , তাকে মু ' তাকিফ বলে ।
ইতিকাফ তিন প্রকার
১ . সুন্নাতে মুআক্কাবাদ ইতিকাফ ।
২ . ওয়াজিব ইতিকাফ ।
৩ . মুস্তাহাব ইতিকাফ ।
১ . সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ
মাহে রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুআক্কাদাহ ।
২ . ওয়াজিব ইতিকাফ
যে ব্যক্তি ইতিকাফ করার মানত করবে | তার ওপর ইতিকাফ আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যাবে । মানত ইতিকাফের জন্য সাওম পালন করা শর্ত । যদি নির্ধারিত কোনাে সময় বা স্থানের মানত করে তাহলে ওই সময় ও স্থানেই ইতিকাফ করতে হবে ।
৩ . মুস্তাহাব ইতিকাফ
রমজান মাস ছাড়া অন্য যেকোনাে সময় মসজিদে ইতিকাফের নিয়তে অবস্থান করা মুস্তাহাব । তবে সুন্নাত ও মুস্তাহাব ইতিকাফের জন্য সাওম পালন করা শর্ত নয়। .................................
ইতিকাফের উদ্দেশ্য
এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম ( রাহঃ ) বলেন , ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলাে , আল্লাহ তায়ালার পাক জাতের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন যেন সব দিক থেকে ফিরে একমাত্র তাঁরাই সাথে একত্র হওয়া যায় এবং তিনি ব্যতীত সব কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে তারই মধ্যে ডুবে যাওয়া যায় এবং যাবতীয় ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে তারই পবিত্র সত্তায় মগ্ন হওয়া । ধারণাসহ সব ক্ষেত্রে তার পবিত্র জিকর ও মুহব্বতকে স্থান দেয়া , এমনকি তামাম সৃষ্টিকুলের ভালােবাসার পরিবর্তে যেন আল্লাহ পাকের সাথে ভালােবাসা সৃষ্টি হয়ে যায় । হযরত আবু সাঈদ কুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত , রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের প্রথম দশকে ইতিকাফ করতেন , তারপর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ইতিকাফ করলেন । তারপর তিনি তার পর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ইতিকাফ করলেন । তারপর তিনি যে তুর্কি তাঁবুর ভেতরে অবস্থান করছিলেন তা থেকে মাথা বের করে বললেন , আমি এ রাতটি অর্থাৎ শবে কদরের সন্ধানে প্রথম দশক ইতিকাফ করলাম । তারপর মধ্যম দশকেও ইতিকাফ করলাম , তারপর জনৈক আগন্তুক ( ফেরেশতা ) মারফত আমাকে বলা হলাে রাতটি শেষ দশকে নিহিত রয়েছে । সুতরাং আমার সাথে যারা ইতিকাফ করেছে , তাদের শেষ দশকে ইতিকাফ করা উচিত । ( মিশকাত ) এ হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় , কদরের রাতটি পাওয়াই ইতিকাফের উদ্দেশ্য ।
ইতিকাফের শর্তগুলো
১ . মুসলমান হওয়া ।
২ . ইতিকাফের জন্য নিয়ত করা ।
৩ . পুরুষদের জন্য মসজিদে ছাড়া ইতিকাফ হবে না । তবে মহিলারা নিজ নিজ বাড়িতে ইতিকাফ করবে ।
৪ . শরীর পাক - পবিত্র হতে হবে ।
৫ . রােজাদার হতে হবে ।
৬ . জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে ।
৭ . আবশ্যকীয় প্রয়ােজন ছাড়া মসজিদে অবস্থান করতে হবে ।
ইতিকাফের আদাব
ইতিকাফের আদাব নিন্মােক্ত বিষয়গুলাে ইতিকাফে মুস্তাহাব ।
১ . কল্যাণকর কথা ছাড়া বাজে কথা না বলা । তবে নীরবে সময় কাটা মাকরুহ । ২ . ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম মসজিদ গ্রহণ করা । অর্থাৎ যে মক্কাতে থাকে তার জন্য । মসজিদে হারাম । মদিনাতে অবস্থানকারীর জন্য মসজিদে নব্বী । যে ব্যক্তি বাইতুল মুক্কাদাসে থাকে তার জন্য মসজিদে । আকসা । অন্যদের জন্য জামে মসজিদে ইতিকাফ করা । ৩ . কুরআন তিলাওয়াত , মাসনুন জিকির , নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - এর ওপর দরুদ পড়া , ওয়াজ নসিহত করা এবং ধর্মীয় বই পুস্তক অধ্যয়ন ও রচনায় লিপ্ত থাকা ।
ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলাম যেহেতু বৈরাগ্যের ধর্ম নয় , সামাজিকতার ধর্ম , তাই আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্য অন্যান্য জাতির সাধক , সন্ন্যাসীদের মতাে লােকালয় পরিত্যাগ করতে বলা হয়নি , বরং লােকালয়ে ইবাদত কেন্দ্র মসজিদে অবস্থানের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে তৎপর হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে । ইতিকাফের এই পুণ্য । সময়টুকুতে আল্লাহপ্রেমে নিবেদিত সাচ্চা | মুমিন ব্যক্তিদের সৎ সাহচর্য লাভেরও এক অপূর্ব সুযােগ উপস্থিত হয় । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির মানসে এক দিন ইতিকাফ পালন করে , আল্লাহ তার এবং জাহান্নামের মধ্যে তিনটি গহ্বর সৃষ্টি করবেন যার দূরত্ব আসমান জমিনের দূরত্বের চেয়ে অধিক । ( তিবরানী ) ইতিকাফ জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম । ইতিকাফ সুন্নতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া । এটি মসজিদে যদি কিছুসংখ্যক সাওম পালনকারী ইতিকাফ করেন তাতে গােটা মহল্লা বা মসজিদের মুসল্লিদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে । আর যদি কেউ ইতিকাফ না করেন গােটা মহল্লাবাসী গুনাহগার হবে । ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) বর্ণিত হাদীসে আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেন , সে ব্যক্তি গুনাহর আবিলতা থেকে মুক্ত থাকে এবং তার জন্য সেসব নেকি লিপিবদ্ধ করা হয় যেমনটি সেসব পুণ্য কাজ যারা করে তাদের জন্য লিখিত থাকে । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন - যে ব্যক্তি কোনাে একদিন ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অতিবাহিত করে । জাহান্নাম তার থেকে আসমান - জমীনের দূরত্বের তিন গুণ দূরে সরে যায় । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম | আরাে বলেন - যে ব্যক্তি এক দিনও ইতিকাফে বসবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার মধ্যে এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দকের ব্যবধান করবেন । এক খন্দক পাঁচশত বছরের পথ । হজরত আবু হুরায়রা রাঃ বলেন - রাসূল | সাঃ প্রতি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন । কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেন । ( বুখারি - মুসলিম ) । হজরত আয়েশা | রাঃ বলেন , রাসূল সাঃ প্রতি বছর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন । ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত তিনি এ নিয়ম পালন করেন । তার ইন্তিকালের পর তার স্ত্রীরা এ নিয়ম জারি রাখেন । ( বুখারি ) । হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত । আছে , রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত বন্দেগীর কাজে এতই কষ্ট স্বীকার করতেন যা অন্য সময় করতেন না । হযরত জয়নব বিবৃত হয়েছে , রমজানের শেষ দশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘরের লােকদের মধ্যে জেগে ইবাদত করতে সক্ষম এমন কাউকে ঘুমাতে দিতেন না এবং প্রত্যেককেই জাগ্রত থেকে ইবাদত করার আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাে বলেছেন : যে ব্যক্তি খালেস নিয়তে এবং খাঁটি ঈমানের | সাথে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে , তার পূর্ববর্তী সব সগীরাহ গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে । সুতরাং উপরিউক্ত হাদীসের মাধ্যমে ইতিকাফের মহত্ত ও ফজীলত সবার কাছে দিবালােকের মতাে স্পষ্ট ।
ইতিকাফের কিছু জরুরী মাসআলা
১ . সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ যেহেতু শেষ । | দশদিন ব্যাপী , তাই প্রথম থেকেই পুরাে দশ দিনের ইতিকাফের নিয়ত করে নিতে হবে । একসাথে দশদিনের নিয়ত না করলে সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ আদায় হবে না ; বরং তা নফলে পরিণত হবে ।
২ . বিশ তারিখ সূর্যাস্তের আগেই ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে পৌঁছা জরুরী ।
৩ . সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রােযা রাখা জরুরী । কোনাে কারণে রােযা রাখতে না পারলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে ।
৪ . ইতিকাফ অবস্থায় প্রয়ােজনীয় দুনিয়াবী কথাও বলা যাবে । মােবাইলে কারাে সাথে আলাপ করা যাবে । তবে প্রয়ােজন ছাড়া | দুনিয়াবী কথা - বার্তায় লিপ্ত হওয়া ঠিক নয় এতে ইতিকাফের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়ে যায় ।
৫ . ডাক্তারগণ প্রয়ােজনে চিকিৎসাপত্র লিখে দিতে পারবেন । তবে বিনিময় নিতে পারবেন না ।
৬ . মসজিদের মুয়াজ্জিন যদি ইতিকাফ করেন , আর আজানের জায়গা যদি মসজিদের বাইরে হয় তাহলে বাইরে গিয়ে | তার জন্য আজান দেয়া জায়েজ ।
৭ . ইতিকাফকারী নফল অজুর জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবে ।
৮ . সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ শুরু করলে তা পূর্ণ করা জরুরী । ওজর ব্যতীত তা ভাঙ্গা জায়েয নয় ।
৯ . পুরুষরা মসজিদে ও নারীরা
ঘরে নামাযের স্থানে ইতিকাফ করবে । নারীদের ঘরে নামাযের জায়গা নির্দিষ্ট না থাকলে কয়েক ওয়াক্ত নামায পড়ে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে নেবে ।
১০ . শরঈ মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ সহীহ হয় না । শরঈ মসজিদ পাঞ্জেগানা হােক বা জামে মসজিদ হােক উভয়টিতেই ইতিকাফ বিশুদ্ধ হবে ।
১১ . মল - মূত্র ত্যাগ অজু ও ফরজ ও সুন্নত গােসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে । স্বাভাবিক গােসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না । স্বাভাবিক গােসল না করলে খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি হলে মসজিদের ভেতর বসে মাথা বের করে দিয়ে মাথায় পানি ঢালবে । তাতেও সমস্যা না কাটলে অজু - ইস্তিঞ্জার জন্য যখন মসজিদ | থেকে বের হবে , আসার পথে যদি পানির ব্যবস্থা থাকে , অতিদ্রুত গােসল সেরে নেবে । শুধু গােসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয হবে না ।
১২ . পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করা ও করানাে উভয়ই নাজায়েজ ।
নারীদের ইতিকাফ
১ . নারীরা তাদের ঘরের নামাযের স্থানে ইতিকাফ করবে । নামাযের জন্য নির্দিষ্ট কোনাে জায়গা নির্ধারিত না থাকলে ইতিকাফের কয়েকদিন আগ থেকে কয়েক ওয়াক্ত নামায পড়ে একটি জায়গাকে নামাযের জায়গা হিসেবে নির্দিষ্ট করে নেবে । এরপর সেখানে ইতিকাফ করবে ।
২ . নারীরা ইতিকাফের নির্দিষ্ট স্থান ঘরের অন্য কোথাও যাবে না । অন্যত্র গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে ।
৩ . নারীদের ইতিকাফ স্বামীর অনুমতি স্বাপেক্ষে হতে হবে । স্বামীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইতিকাফ করলে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না । নারীদের পিরিয়ড ( ঋতু ) অবস্থায় । ইতিকাফ করা শুদ্ধ নয় । কারণ , পিরিয়ড শুরু হলে রােযা রাখা যায় না ; অথচ সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফের জন্য রােযা রাখা | জরুরী । তাই তাদের জন্য উচিত পিরিয়ডের | দিনগুলাের শুরু - শেষের দিকে লক্ষ্য রেখে ।সত্ত্বেও ইতিকাফ করলে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না । নারীদের পিরিয়ড ( ঋতু ) অবস্থায় ইতিকাফ করা শুদ্ধ নয় । কারণ , পিরিয়ড । শুরু হলে রােযা রাখা যায় না ; অথচ সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফের জন্য রােযা রাখা জরুরী । তাই তাদের জন্য উচিত পিরিয়ডের দিনগুলাের শুরু - শেষের দিকে লক্ষ্য রেখে ইতিকাফ করা ।
ইতিকাফকারী কিভাবে সময় কাটাবে ?
ইতিকাফের সময়গুলাে তাসবীহ - তাহলীল ও ইবাদত - বন্দেগিতে কাটাবে । কিছু দ্বীনী মাসআলা - মাসায়িলের কিতাবাদি পড়াশােনা করা যেতে পারে । সেগুলাে পড়ে অন্যকে শােনানাে যেতে পারে । বেশি বেশি কুরআনে কারীমের তেলাওয়াত করা , কুরআনের অর্থ বুঝা ও তার ব্যাখ্যা - বিশ্লেষণ অনুধাবন ইত্যাদিতে সময় কাটানাে যেতে পারে । ইতিকাফ অবস্থায় একদম চুপ থাকা মাকরূহ তাহরীমী ।
ইতিকাফের উদ্দেশ্য
এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে আল্লামা ইবনুল কাইয়্যিম ( রাহঃ ) বলেন , ইতিকাফের উদ্দেশ্য হলাে , আল্লাহ তায়ালার পাক জাতের সাথে নিবিড় সম্পর্ক স্থাপন যেন সব দিক থেকে ফিরে একমাত্র তাঁরাই সাথে একত্র হওয়া যায় এবং তিনি ব্যতীত সব কিছু থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করে তারই মধ্যে ডুবে যাওয়া যায় এবং যাবতীয় ব্যবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে তারই পবিত্র সত্তায় মগ্ন হওয়া । ধারণাসহ সব ক্ষেত্রে তার পবিত্র জিকর ও মুহব্বতকে স্থান দেয়া , এমনকি তামাম সৃষ্টিকুলের ভালােবাসার পরিবর্তে যেন আল্লাহ পাকের সাথে ভালােবাসা সৃষ্টি হয়ে যায় । হযরত আবু সাঈদ কুদরী ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত , রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের প্রথম দশকে ইতিকাফ করতেন , তারপর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ইতিকাফ করলেন । তারপর তিনি তার পর তিনি দ্বিতীয় দশকেও ইতিকাফ করলেন । তারপর তিনি যে তুর্কি তাঁবুর ভেতরে অবস্থান করছিলেন তা থেকে মাথা বের করে বললেন , আমি এ রাতটি অর্থাৎ শবে কদরের সন্ধানে প্রথম দশক ইতিকাফ করলাম । তারপর মধ্যম দশকেও ইতিকাফ করলাম , তারপর জনৈক আগন্তুক ( ফেরেশতা ) মারফত আমাকে বলা হলাে রাতটি শেষ দশকে নিহিত রয়েছে । সুতরাং আমার সাথে যারা ইতিকাফ করেছে , তাদের শেষ দশকে ইতিকাফ করা উচিত । ( মিশকাত ) এ হাদীস থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় , কদরের রাতটি পাওয়াই ইতিকাফের উদ্দেশ্য ।
ইতিকাফের শর্তগুলো
১ . মুসলমান হওয়া ।
২ . ইতিকাফের জন্য নিয়ত করা ।
৩ . পুরুষদের জন্য মসজিদে ছাড়া ইতিকাফ হবে না । তবে মহিলারা নিজ নিজ বাড়িতে ইতিকাফ করবে ।
৪ . শরীর পাক - পবিত্র হতে হবে ।
৫ . রােজাদার হতে হবে ।
৬ . জ্ঞানসম্পন্ন ও প্রাপ্তবয়স্ক হতে হবে ।
৭ . আবশ্যকীয় প্রয়ােজন ছাড়া মসজিদে অবস্থান করতে হবে ।
ইতিকাফের আদাব
ইতিকাফের আদাব নিন্মােক্ত বিষয়গুলাে ইতিকাফে মুস্তাহাব ।
১ . কল্যাণকর কথা ছাড়া বাজে কথা না বলা । তবে নীরবে সময় কাটা মাকরুহ । ২ . ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম মসজিদ গ্রহণ করা । অর্থাৎ যে মক্কাতে থাকে তার জন্য । মসজিদে হারাম । মদিনাতে অবস্থানকারীর জন্য মসজিদে নব্বী । যে ব্যক্তি বাইতুল মুক্কাদাসে থাকে তার জন্য মসজিদে । আকসা । অন্যদের জন্য জামে মসজিদে ইতিকাফ করা । ৩ . কুরআন তিলাওয়াত , মাসনুন জিকির , নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম - এর ওপর দরুদ পড়া , ওয়াজ নসিহত করা এবং ধর্মীয় বই পুস্তক অধ্যয়ন ও রচনায় লিপ্ত থাকা ।
ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত
ইসলাম যেহেতু বৈরাগ্যের ধর্ম নয় , সামাজিকতার ধর্ম , তাই আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্য অন্যান্য জাতির সাধক , সন্ন্যাসীদের মতাে লােকালয় পরিত্যাগ করতে বলা হয়নি , বরং লােকালয়ে ইবাদত কেন্দ্র মসজিদে অবস্থানের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে তৎপর হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়েছে । ইতিকাফের এই পুণ্য । সময়টুকুতে আল্লাহপ্রেমে নিবেদিত সাচ্চা | মুমিন ব্যক্তিদের সৎ সাহচর্য লাভেরও এক অপূর্ব সুযােগ উপস্থিত হয় । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন , যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির মানসে এক দিন ইতিকাফ পালন করে , আল্লাহ তার এবং জাহান্নামের মধ্যে তিনটি গহ্বর সৃষ্টি করবেন যার দূরত্ব আসমান জমিনের দূরত্বের চেয়ে অধিক । ( তিবরানী ) ইতিকাফ জাহান্নাম থেকে মুক্তির মাধ্যম । ইতিকাফ সুন্নতে মুআক্কাদায়ে কিফায়া । এটি মসজিদে যদি কিছুসংখ্যক সাওম পালনকারী ইতিকাফ করেন তাতে গােটা মহল্লা বা মসজিদের মুসল্লিদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে । আর যদি কেউ ইতিকাফ না করেন গােটা মহল্লাবাসী গুনাহগার হবে । ইবনে আব্বাস ( রাঃ ) বর্ণিত হাদীসে আছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেন , সে ব্যক্তি গুনাহর আবিলতা থেকে মুক্ত থাকে এবং তার জন্য সেসব নেকি লিপিবদ্ধ করা হয় যেমনটি সেসব পুণ্য কাজ যারা করে তাদের জন্য লিখিত থাকে । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন - যে ব্যক্তি কোনাে একদিন ইতিকাফ অবস্থায় মসজিদে অতিবাহিত করে । জাহান্নাম তার থেকে আসমান - জমীনের দূরত্বের তিন গুণ দূরে সরে যায় । রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম | আরাে বলেন - যে ব্যক্তি এক দিনও ইতিকাফে বসবে আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন তার মধ্যে এবং জাহান্নামের মধ্যে তিন খন্দকের ব্যবধান করবেন । এক খন্দক পাঁচশত বছরের পথ । হজরত আবু হুরায়রা রাঃ বলেন - রাসূল | সাঃ প্রতি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন । কিন্তু যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি ২০ দিন ইতিকাফ করেন । ( বুখারি - মুসলিম ) । হজরত আয়েশা | রাঃ বলেন , রাসূল সাঃ প্রতি বছর রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন । ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত তিনি এ নিয়ম পালন করেন । তার ইন্তিকালের পর তার স্ত্রীরা এ নিয়ম জারি রাখেন । ( বুখারি ) । হযরত আয়েশা ( রাঃ ) থেকে বর্ণিত । আছে , রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমজানের শেষ দশকে ইবাদত বন্দেগীর কাজে এতই কষ্ট স্বীকার করতেন যা অন্য সময় করতেন না । হযরত জয়নব বিবৃত হয়েছে , রমজানের শেষ দশকে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর ঘরের লােকদের মধ্যে জেগে ইবাদত করতে সক্ষম এমন কাউকে ঘুমাতে দিতেন না এবং প্রত্যেককেই জাগ্রত থেকে ইবাদত করার আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরাে বলেছেন : যে ব্যক্তি খালেস নিয়তে এবং খাঁটি ঈমানের | সাথে সওয়াবের উদ্দেশ্যে ইতিকাফ করবে , তার পূর্ববর্তী সব সগীরাহ গুনাহ মাফ করে দেয়া হবে । সুতরাং উপরিউক্ত হাদীসের মাধ্যমে ইতিকাফের মহত্ত ও ফজীলত সবার কাছে দিবালােকের মতাে স্পষ্ট ।
ইতিকাফের কিছু জরুরী মাসআলা
১ . সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ যেহেতু শেষ । | দশদিন ব্যাপী , তাই প্রথম থেকেই পুরাে দশ দিনের ইতিকাফের নিয়ত করে নিতে হবে । একসাথে দশদিনের নিয়ত না করলে সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ আদায় হবে না ; বরং তা নফলে পরিণত হবে ।
২ . বিশ তারিখ সূর্যাস্তের আগেই ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে পৌঁছা জরুরী ।
৩ . সুন্নতে মুয়াক্কাদা ও ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রােযা রাখা জরুরী । কোনাে কারণে রােযা রাখতে না পারলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে ।
৪ . ইতিকাফ অবস্থায় প্রয়ােজনীয় দুনিয়াবী কথাও বলা যাবে । মােবাইলে কারাে সাথে আলাপ করা যাবে । তবে প্রয়ােজন ছাড়া | দুনিয়াবী কথা - বার্তায় লিপ্ত হওয়া ঠিক নয় এতে ইতিকাফের মাহাত্ম্য নষ্ট হয়ে যায় ।
৫ . ডাক্তারগণ প্রয়ােজনে চিকিৎসাপত্র লিখে দিতে পারবেন । তবে বিনিময় নিতে পারবেন না ।
৬ . মসজিদের মুয়াজ্জিন যদি ইতিকাফ করেন , আর আজানের জায়গা যদি মসজিদের বাইরে হয় তাহলে বাইরে গিয়ে | তার জন্য আজান দেয়া জায়েজ ।
৭ . ইতিকাফকারী নফল অজুর জন্য মসজিদের বাইরে যেতে পারবে ।
৮ . সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফ শুরু করলে তা পূর্ণ করা জরুরী । ওজর ব্যতীত তা ভাঙ্গা জায়েয নয় ।
৯ . পুরুষরা মসজিদে ও নারীরা
ঘরে নামাযের স্থানে ইতিকাফ করবে । নারীদের ঘরে নামাযের জায়গা নির্দিষ্ট না থাকলে কয়েক ওয়াক্ত নামায পড়ে একটি জায়গা নির্দিষ্ট করে নেবে ।
১০ . শরঈ মসজিদ ছাড়া ইতিকাফ সহীহ হয় না । শরঈ মসজিদ পাঞ্জেগানা হােক বা জামে মসজিদ হােক উভয়টিতেই ইতিকাফ বিশুদ্ধ হবে ।
১১ . মল - মূত্র ত্যাগ অজু ও ফরজ ও সুন্নত গােসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে । স্বাভাবিক গােসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না । স্বাভাবিক গােসল না করলে খুব বেশি সমস্যা সৃষ্টি হলে মসজিদের ভেতর বসে মাথা বের করে দিয়ে মাথায় পানি ঢালবে । তাতেও সমস্যা না কাটলে অজু - ইস্তিঞ্জার জন্য যখন মসজিদ | থেকে বের হবে , আসার পথে যদি পানির ব্যবস্থা থাকে , অতিদ্রুত গােসল সেরে নেবে । শুধু গােসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয হবে না ।
১২ . পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ইতিকাফ করা ও করানাে উভয়ই নাজায়েজ ।
নারীদের ইতিকাফ
১ . নারীরা তাদের ঘরের নামাযের স্থানে ইতিকাফ করবে । নামাযের জন্য নির্দিষ্ট কোনাে জায়গা নির্ধারিত না থাকলে ইতিকাফের কয়েকদিন আগ থেকে কয়েক ওয়াক্ত নামায পড়ে একটি জায়গাকে নামাযের জায়গা হিসেবে নির্দিষ্ট করে নেবে । এরপর সেখানে ইতিকাফ করবে ।
২ . নারীরা ইতিকাফের নির্দিষ্ট স্থান ঘরের অন্য কোথাও যাবে না । অন্যত্র গেলে ইতিকাফ ভেঙ্গে যাবে ।
৩ . নারীদের ইতিকাফ স্বামীর অনুমতি স্বাপেক্ষে হতে হবে । স্বামীর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইতিকাফ করলে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না । নারীদের পিরিয়ড ( ঋতু ) অবস্থায় । ইতিকাফ করা শুদ্ধ নয় । কারণ , পিরিয়ড শুরু হলে রােযা রাখা যায় না ; অথচ সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফের জন্য রােযা রাখা | জরুরী । তাই তাদের জন্য উচিত পিরিয়ডের | দিনগুলাের শুরু - শেষের দিকে লক্ষ্য রেখে ।সত্ত্বেও ইতিকাফ করলে ইতিকাফ শুদ্ধ হবে না । নারীদের পিরিয়ড ( ঋতু ) অবস্থায় ইতিকাফ করা শুদ্ধ নয় । কারণ , পিরিয়ড । শুরু হলে রােযা রাখা যায় না ; অথচ সুন্নতে মুয়াক্কাদা ইতিকাফের জন্য রােযা রাখা জরুরী । তাই তাদের জন্য উচিত পিরিয়ডের দিনগুলাের শুরু - শেষের দিকে লক্ষ্য রেখে ইতিকাফ করা ।
ইতিকাফকারী কিভাবে সময় কাটাবে ?
ইতিকাফের সময়গুলাে তাসবীহ - তাহলীল ও ইবাদত - বন্দেগিতে কাটাবে । কিছু দ্বীনী মাসআলা - মাসায়িলের কিতাবাদি পড়াশােনা করা যেতে পারে । সেগুলাে পড়ে অন্যকে শােনানাে যেতে পারে । বেশি বেশি কুরআনে কারীমের তেলাওয়াত করা , কুরআনের অর্থ বুঝা ও তার ব্যাখ্যা - বিশ্লেষণ অনুধাবন ইত্যাদিতে সময় কাটানাে যেতে পারে । ইতিকাফ অবস্থায় একদম চুপ থাকা মাকরূহ তাহরীমী ।
No comments:
Post a Comment